রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৭:৩৭ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণে মুসলমানদের অবদান

অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণে মুসলমানদের অবদান

বিশ্বব্যাপী দাপিয়ে বেড়ানো ভয়াল করোনাভাইরাসকে মোকাবেলা করার জন্য বিশ্বের অনেক দেশেই গড়ে উঠেছে করোনা চিকিৎসার আলাদা অস্থায়ী হাসপাতাল। তার ধারাবাহিকতায় দেশের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের উদ্যোগে বাংলাদেশেও গড়ে উঠছে একটি বিশাল ও আধুনিক অস্থায়ী হাসপাতাল।

ইসলামের সোনালি যুগেও অসুস্থ রোগীদের উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার জন্য আলাদা অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণের নজির রয়েছে, যা শুরু করেছিলেন প্রিয় নবী (সা.) বিশিষ্ট সাহাবি হজরত সাআদ (রা.)-এর জন্য। খন্দকের যুদ্ধে হজরত সাআদ (রা.) আহত হলে রাসুল (সা.) মসজিদের ভেতর আলাদা তাঁবু করে তাঁর জন্য অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করেছিলেন। যাতে রাসুল (সা.) সকাল-সন্ধ্যা তাঁর খোঁজখবর নিতে পারেন।

এই ঘটনাটি হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। যা বুখারি, আবু দাউদসহ বহু হাদিস গ্রন্থে পাওয়া যায়। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, খন্দকের যুদ্ধের দিন এক ব্যক্তির নিক্ষিপ্ত তীরে সাআদ ইবনে মুআজ (রা.) আঘাতপ্রাপ্ত হলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর জন্য মসজিদের ভেতর একটি তাঁবু টানালেন, যেন তিনি কাছ থেকে তাঁকে দেখতে পারেন। (আবু দাউদ, হাদিস ৩১০১)

শুধু তা-ই নয়, সেই হাসপাতালে হজরত সাআদ (রা.)-কে চিকিৎসাসেবা প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল হজরত রুফাইদা (রা.)-কে। কারো কারো মতে, হজরত রুফাইদা (রা.) ছিলেন ইসলামের প্রথম নারী চিকিৎসক। বিভিন্ন যুদ্ধে তিনি আলাদা তাঁবুতে যুদ্ধাহত সাহাবায়ে কেরামের চিকিৎসা দিতেন। তাঁর সেই বিশেষ অস্থায়ী হাসপাতালের নাম ছিল ‘খিমাতু রুফাইদা’। মাহমুদ ইবনে লাবিদ (রহ.) থেকে বর্ণিত, খন্দকের যুদ্ধের দিন সাআদ (রা.)-এর চোখ আঘাতপ্রাপ্ত হলে এবং তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটলে তাঁকে রুফাইদা নামের এক মহিলার কাছে পৌঁছে দেওয়া হলো। তিনি আহতদের চিকিৎসা করতেন। নবী (সা.) সকাল-সন্ধ্যা সাআদ (রা.)-এর কাছ দিয়ে যেতে জিজ্ঞেস করতেন, তোমার দিন কেমন কাটল, তোমার রাত কেমন কাটল? তিনি তাঁকে (নিজ অবস্থা) অবহিত করতেন। (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস ১১৩৯)

আজকের পৃথিবীর ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল ও চিকিৎসার ধারণাটি এখান থেকেই মানুষ নিয়েছে। (এডি জাব্বার, ইউনে হিসতোরিয়ে, পৃষ্ঠা : ৩১৯)

রাসুল (সা.)-এর ইন্তিকালের পরেও খলিফা ও শাসকদের আমলে ভ্রাম্যমাণ এ চিকিৎসা চালু ছিল। উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক বিন মারওয়ান বিপুল অর্থ ব্যয়ে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এক বিশাল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তাঁর সন্তান আল ওয়ালিদ ইবনে মালিক পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম মানসিক হাসপাতাল নির্মাণ করেন। আব্বাসীয় খলিফা হারুন অর রশিদ ৮০৫ হিজরিতে ইরাকের বাগদাদে সাধারণ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুদিনের মধ্যে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ৩০টির বেশি এমন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়।

৮৭২ সালে মিসরের কায়রোতে প্রথম হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন আহমদ ইবনে তুলুন। এভাবেই মুসলিম শাসনামলে বিশ্বব্যাপী উন্নত হাসপাতালব্যবস্থা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তৎকালীন যুগে শুধু স্পেনের কর্ডোভা শহরেই গড়ে উঠেছিল ৫০টির বেশি হাসপাতাল। তার মধ্যে কোনো হাসপাতাল ছিল সামরিক বাহিনীর জন্য নির্দিষ্ট। বর্তমান বিশ্বের সামরিক বাহিনীর জন্য প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালের ধারণাটি মুসলমানদের।

মুসলিম শাসনামলে ভারতবর্ষেও অনেক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যেমন—ভারতে মুসলিম শাসক ফিরোজ শাহ তুঘলকের হাসপাতালকে বলা হতো ‘সিহহতখানা’। সেখানে হাসপাতালের পক্ষ থেকেই রোগীদের খাবার সরবরাহ করা হতো। এ ছাড়া আহমেদাবাদে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সুলতান আলাউদ্দিন বিন সুলতান আহমদ শাহ বাহামানি। এরপর ৮৪৯ হিজরিতে মালোয়ার শাসক মাহমুদ খিলজি শাদিয়াবাদে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন।

মোগল বাদশাহদের মধ্যে জাহাঙ্গীর সর্বপ্রথম হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হন। গুরুত্বের সঙ্গে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন। সেকালের একজন বিখ্যাত চিকিৎসক হেকিম আলী প্রতিবছর দরিদ্রদের মধ্যে প্রায় ছয় হাজার ওষুধ বিলি করতেন। এভাবেই মুসলিমদের হাত ধরে দুনিয়াব্যাপী চিকিৎসাব্যবস্থা ও হাসপাতালের বিস্তার ঘটেছে। কারণ মুসলমানরা বিশ্বাস করত, সেবা রোগীর অধিকার। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “এক মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের ছয়টি অধিকার…‘যখন যে অসুস্থ হবে তার সেবা করো।’ ” (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২১৬২)।

আর যারা কোনো রোগীর সেবায় নিয়োজিত থাকবে, মহান আল্লাহ তাদের বিশেষ পুরস্কারে পুরস্কৃত করবেন।

আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো মুসলমান যদি অন্য কোনো মুসলিম রোগীকে সকালে দেখতে যায়, তাহলে ৭০ হাজার ফেরেশতা তার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত দোয়া করতে থাকে। সে যদি সন্ধ্যায় তাকে দেখতে যায়, তবে ৭০ হাজার ফেরেশতা ভোর পর্যন্ত তার জন্য দোয়া করতে থাকে এবং জান্নাতে তার জন্য একটি ফলের বাগান তৈরি হয়।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস ৯৬৯)। আমরা সবাই জানি, ফেরেশতাদের কোনো পাপ নেই। অতএব, যার জন্য ৭০ হাজার ফেরেশতা দোয়া করবে, তার মর্যাদা মহান আল্লাহর কাছে কতটা বৃদ্ধি পাবে।

তাই যাঁরা যেভাবে বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে উন্নত চিকিৎসাসেবার পরিবেশ সৃষ্টি করতে কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁরা সবাই মহান আল্লাহর কাছে উত্তম প্রতিদান পাবেন—ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহ সবার প্রচেষ্টাগুলো কবুল করে নিন। আমিন।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877